- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ·
- খুলনাঞ্চল
- ·
- ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪ | বিকাল ৫:৩৩
নিজস্ব প্রতিবেদক | ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪ | শনিবার | বিকাল ৫:৩৩
★জেলেদের শারীরিক ও মানষিক ভাবে নির্যাতন করে আদায় করা হয় মুক্তিপন।
★ মোবাইলের (বিকাশ ও নগদের) মাধ্যমে নেওয়া হয় মুক্তিপনের টাকা।
★সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নজরদারির অভাবে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে বনদস্যুরা দাবি সচেতন নাগরিকদের ।
★ স্থানীয় কোন প্রভাবশালী মহলের সহযোগিতা আছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখার আহ্বান স্থানীয়দের।
সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের নলবুনিয়া, খাঁশিটানা, বজবুজিয়া,মোল্লাখালী, মার্কি, নিশিন খালী, খড়কুড়িয়া, মান্দারবাড়িয়া, আড়ুয়া শিবসা, আদাঁচাই, পাতকোষ্ট, গেওয়াখালী ভোমরখালী, আন্ধার মানিক,নীলকমল, কাগা -দোবেকী, হংসরাজ, সহ খুলনা রেঞ্জের অধিকাংশ জায়গায় জলদস্যুদের আনাগোনার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৪/৫ মাসে পশ্চিম সুন্দরবনে অন্তত ১০টির ও বেশি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে, ৮ নভেম্বর কয়রা উপজেলার দুই জেলে আতাহার হোসেন ও রফিকুল ইসলামকে অপহরণ করা হয়েছিল। জানা যায়, ডাকাত দল নিজেদের দয়াল বাহিনীর সদস্য পরিচয় দেয় । এরপরে তাদের জিম্মি করে পরিবারের কাছে কাছে ৪ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছিল। সেই টাকা পাওয়ার পর তাদের মুক্ত করে বনদস্যুরা ।
২০১৮ সালে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত অঞ্চল বলে ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ সরকার। তবে সম্প্রতি, ফের বাংলাদেশের অন্তর্গত সুন্দরবনে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বনদস্যুদল। অপহরণ, মুক্তিপণ দাবি এবং সহিংস ডাকাতির ঘটনার বেড়ে যাওয়ায় আবার এই অঞ্চলটি অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় এলাকায় নজরদারি বাড়ানোর দাবি উঠেছে স্থানীয়দের ।
এই অঞ্চলে ডাকাতদলকে সমাজের মূল স্রোতে ফেরার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। তারপরেই বহু দুষ্কৃতিকারী আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে ।
আইনশৃঙ্খলা বাহীনির সূত্রে জানা গেছে , ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৩২টি দলের ৩২৮ জন দুষ্কৃতী আত্মসমর্পণ করেছে। তারা ৪৬২টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২২,০২৪ রাউন্ড গোলাবারুদ হস্তান্তর করেছে। আত্মসমর্পণের পর অনেক দুষ্কৃতীকারি সরকারি পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় আর্থিক সহায়তাও পেয়েছিল। তবে গত কয়েক বছর ধরে নিয়মিত নজরদারির অভাবের কারণে এই দুষ্কৃতীকারিদের মধ্যে বেশ কিছু পুনরায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ফিরে এসেছে। তারা মৎসজীবী এবং মধু সংগ্রহকারীদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে।যার ফলে সুন্দরবনের উপরে নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করা জেলে -বাওয়ালী ও মৌয়ালদের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে এলাকাটি।
তবে অভিযোগ উঠেছে, এসব এলাকায় প্রশাসনের নজরদারি কমে যাওয়ার কারণেই সেখানে অপরাধ প্রবনতা বেড়েই চলেছে ।স্থানীয়দের অভিযোগ, আসাবুর বাহিনী, শরীফ বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী এবং আলিফ ওরফে দয়াল বাহিনী, সাগর বাহিনী -আলম ওরফে পাটওয়ারী বাহীনি, বিশেষ করে পশ্চিম সুন্দরবন, খুলনার কয়রা ও দাকোপ উপজেলা এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা জুড়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে এই ডাকাত দল। শুধু তাই নয়, গত ৫ই আগষ্ট বাংলাদেশে ছাত্র জনতা আন্দোলনের সময় জেল থেকে পালিয়ে যাওয়া কিছু আসামি ওর ২০২৪ গন অভ্যুত্থানের পরে নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্য ও পতিত স্বৈরাচারী সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের সদস্যরা একাজে জড়িয়ে পড়তে পারে বলে সুশীল ও বিভিন্ন মহলের ধারণা। এই ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যোগ দিয়েছে। তবে কয়েকদিন আগে আসাবুর বাহিনীর প্রধান আসাবুর সহ তার সহযোগী আটক হয়।
গত ১৬ ডিসেম্বর কয়রা উপজেলার দশহালিয়া গ্রামের শের আলী মোল্যার ছেলে ইমদাদুল হক (৩৩) সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার হরিনগর গ্রামের নাজির সরদারের ছেলে রেজাউল ইসলাম (৩৮)ও গোলাম মোস্তফার ছেলে সুজন গাজী (২৭) সুন্দরবনের ফিরিঙ্গি নদীর মোল্যাখালী খাল থেকে সাত সদস্যর একটি বনদস্যু দল তাদের অপহরণ করে। পরবর্তীতে জিম্মি জেলেদের পরিবারের সাথে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে মুক্তিপনের পরিমান যানাবে বলেও যানান তারা। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তারা (অপহরিত জেলেরা) এখনো মুক্তি পায়নি।
২নং কয়রা গ্রামের জেলে শাহাদাৎ হোসেন(ছদ্মনাম) বলেন, আমরা নৌকা সাজিয়ে ৩ জনের একটি বহার নিয়ে পাশ করে (বিএলসি)সুন্দরবনে মাছ ধরার জন্য যাই। তখন শিবশা এলাকায় আমরা ডাকাতদলের আক্রমনের স্বীকার হই। তারা আমাদের নৌকা থেকে একজন জেলেকে উঠিয়ে নেয়। পরে ২০হাজার টাকা মুক্তিপন দাবি করে, আমরা পুনরাই বাড়িতে ফিরে মোবাইল ব্যাংকিং এর (বিকাশ) মাধ্যমে মুক্তিপনের ২০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনি। পরে আর সুন্দরবনে মাছ ধরতে যায়নি এখন পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছি।
গত ১৫ দিন আগে কয়রার রাসের (২২)ও খায়রুল ইসলাম (৪০)নামের দুই জেলেকে নিশিনখালী এলাকা থেকে অপহরণ করে সাগর বাহিনী নামের বনদস্যুদল। অপহরণের পর তাদের কাছ থেকে মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশের মাধ্যমে ৯০ হাজার টাকা মুক্তিপন আদায় করে তাদের ছেড়ে দেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলে -বাওয়ালী বলেন, সুন্দরবনে আগের মত বেশ কয়েকটি বনদস্যু (ডাকাতদল) সক্রিয় হয়েছে। এখন আর আগের মত মাছ -কাঁকড়া হয়না, কিন্তু সুন্দরবনে গেলে তাদের টাকা দিতে হবে। টাকা দিতে না পারলে দীর্ঘদিন আটকিয়ে রেখে মানসিক ও শারেরিক নির্যাতন করে থাকে। এই ভয়ে সুন্দরবনে যাচ্ছিনা। তবে এলাকায় তেমন কোন কর্মসংস্থান না থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছি।
তবে এ ব্যাপারে স্থানীয় কোন প্রভাবশালী মহলের সহযোগিতা আছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন সুশিল সমাজের প্রতিনিধিনগন। তাছাড়া জেলে বাওয়ালিরা যাতে পূর্বের ন্যায় আবারো সুন্দরবনে মাছ -কাঁকড়া আহরণ ধরতে পারে সেজন্য কতৃপক্ষ সহ প্রশাসনের নিকট কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জোর দাবি জানিয়েছে।
তবে ইতিপূর্বে সুন্দরবন কেন্দ্রিক অপরাধ ও সন্ত্রাস দমন র্্যাব০৮ বিশেষ ভূমিকা রাখে।র্্যাব ০৮ এর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আবুল বাশার বলেন,বনদস্যু মুক্ত সুন্দরবন ঘোষণার পরে সুন্দরবন অঞ্চল এখন র্যাব ০৬ এর অধীনে ন্যস্ত।তবে র্্যাব ০৮ যেকোনো ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে।
এ বিষয়ে কোষ্টগার্ডের কয়রা ষ্টেশনের কন্টিনজেন্ট কমান্ডার মোঃ শাহ- আলম বলেন, আমরা দুষ্কৃতীকারিদের বিরুদ্ধে নিয়মিত টহল অভিযান ও গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রেখেছি যাতে জেলে বাওয়ালী সুন্দরবনে নির্বিগ্নে মাছ ধরতে পারে।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন,আমাদের কাছে বনদস্যুর বিষয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু তথ্য আসছে। আমরা অনন্য আইনশৃঙ্খলা বাহীনির সাথে নিয়ে দ্রূত অভিযান পরিচালনা করবো। আমরা চেষ্টা করছি সমন্নিত ভাবে কাজ করেতে। যাতে বনদস্যুরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।