খুলনা, বাংলাদেশ
সোমবার | ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪ | ১২:০৪ রাত

কয়রায় প্রশাসন ও এলাকাবাসীর বাঁধা তোয়াক্কা না করে ঠান্ডা পিচে কার্পেটিং করলেন বিএনপি নেতা

সেন্ট্রাল ডেস্ক | ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ | বুধবার | রাত ১১:১৯

খুলনার কয়রায় স্থানীয় প্রশাস‌নের ‌নি‌র্দেশনা অমান‌্য ক‌রে রা‌তের আঁধা‌রে পিচ ঢালাইয়ের কাজ ক‌রে‌ছেন ঠিকাদা‌রের লোকজন। খুলনা জেলা বিএন‌পির সদস্য সচিব আবু হোসেন বাবুর আস্থাভাজন লোক প‌রিচয়ে ভয় দে‌খি‌য়ে স্থানীয়‌দের বাধা উপেক্ষা ক‌রে এটি করেছেন তারা। কয়রা থে‌কে প্রায় ৭০ কি‌লো‌মিটার দূরের আঠা‌রো মাইল থে‌কে ঠাণ্ডা মিক্সার (পিচ ও পাথর) এনে রা‌তের আঁধা‌রে কাজ করায় মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে ক্ষমতার উৎস নিয়েও।

সরজ‌মিনে স্থানীয়‌দের সা‌থে কথা ব‌লে জানা যায়, কয়রা উপ‌জেলার মহারাজপুর ইউনিয়‌নের দেয়াড়া থে‌কে বাগালী ইউনিয়‌নের হোগলা অ‌ভিমু‌খে রাস্তা‌টির সংস্কার কা‌জের মেয়াদ শেষ হ‌লেও বাকি রয়ে‌ছে প্রায় অ‌র্ধেক কাজ। কাজে ধীরগ‌তিসহ নিম্নমা‌নের সামগ্রী দি‌য়ে কাজ করার ব‌্যাপক অ‌ভি‌যোগ ও‌ঠে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠা‌নের বিরুদ্ধে। ড‌ব্লিউবিএমে নিম্নমা‌নের খোয়া ব‌্যবহার, হে‌জিংয়ে দু'নম্বর ইটের ব‌্যবহারসহ প‌্যারাসাইডিং তৈ‌রি‌তে ব‌্যাপক অ‌নিয়ম করা হয়। এ বিষ‌য়ে স্থানীয়রা বারবার প্রশাসন‌কে জা‌নি‌য়েও সুফল পান‌নি। অ‌নিয়ম নি‌য়ে বি‌ভিন্ন গণমাধ‌্যমে প্রতি‌বেদনও প্রকাশ পায়। একপর্যা‌য়ে ক‌য়েক মাস কাজ বন্ধ থা‌কে।

গত ১৭ ডি‌সেম্বর বিকেলে কা‌র্পে‌টিং‌য়ের কাজ শুরু ক‌রে ঠিকাদার। আঠা‌রো মাইল থে‌কে পি‌চের মিশ্রন আনা হয়। পি‌চের মিশ্রন রাস্তায় দেয়া শুরুর একপর্যা‌য়ে সন্ধ‌্যা হয়ে যায়। এরই ম‌ধ্যে তিন‌টি গা‌ড়ি ভ‌র্তি পিচের মিশ্রণ ঠাণ্ডা হ‌য়ে যায়। স্থানীয় ক‌য়েকজন গি‌য়ে সেখা‌নে পিচ গরম ক‌রে ব‌্যবহা‌রের কথা বল‌লে তারা সেটা কর্ণপাত ক‌রেননি। স্থানীয় ইউপি সদস‌্য আব্দুল মান্নান উপ‌স্থিত এল‌জিইডির উপসহকারী প্রকৌশলী আফজাল হো‌সেনের কা‌ছে কা‌জের মান বজায় রাখতে অনু‌রোধ ক‌রলেও তি‌নি আম‌লে নেন‌নি। বিষয়‌টি জানাজা‌নি হওয়ার প‌রে স্থানীয় চেয়ারম‌্যান, সংবাদকর্মী, আইনজী‌বী ঘটনাস্থ‌লে উপ‌স্থিত হ‌য়ে উপ‌জেলা প্রকৌশলী দারুল হুদা ও উপ‌জেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস‌কে অব‌হিত করেন। প‌রে পুনরায় কাজ করার চেষ্টা কর‌লে উপ‌জেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপ‌জেলা প্রকৌশলী কাজ বন্ধের নি‌র্দেশনা দেন। তারপরও কোনো কিছুর তোয়‌াক্কা না ক‌রে ঠিকাদা‌রের আস্থাভাজন ক‌তিপয় ব‌্যক্তি এসে পুনরায় ঠাণ্ডা পিচের মিশ্রণ দি‌য়ে কাজ শুরু ক‌রেন। স্থানীয়রা ফের উপ‌জেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অব‌হিত কর‌লে তি‌নি আইনশৃঙ্খলা বা‌হিনী পাঠা‌বেন বলে আশ্বস্ত ক‌রেন। ত‌বে,দীর্ঘ অপেক্ষার প‌রেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো সদস‌্য ঘটনাস্থ‌লে আসেন‌নি। স্থানীয় স‌চেতনমহল উপ‌জেলা প্রশাস‌ন‌কে একা‌ধিকবার অব‌হিত করেও ঠান্ডা পিচ দি‌য়ে কা‌র্পে‌টিং‌য়ের কাজ বন্ধ কর‌তে ব‌্যর্থ হন। 

কয়রা উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্রামীণ সড়ক মেরামত ও সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় কয়রা উপজেলার আরএন্ডএইচ দেয়াড়া থেকে হোগলার হাট জিসি ও গড়ইখালী জিসির চারশ' মিটার রাস্তা সংস্কারের কাজের টেন্ডার পায় মেসার্স রওশনারা এন্টারপ্রাইজ না‌মে খুলনার একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ২০২২ সালে ১৬ অক্টোবর ওই প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে তিন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার শর্তে নোটিশ অব প্রসিউড প্রদান করেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল দপ্তর, খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী।

কাজটির প্রাক্কলিত মূল্য নির্ধারণ করা হয় এক কোটি ৮৫ লাখ ৭ হাজার ৯২৫ টাকা। ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর কাজটি শুরু ও ২০২৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সম্পন্নের নিদের্শনা দেয়া হয়।

 ইউপি সদস‌্য আব্দুল মান্নান বলেন, 'ঠাণ্ডা পিচ ব‌্যবহার করায় আমি উপসহকা‌রী প্রকৌশলী‌কে জানা‌লে প্রথ‌মে তি‌নি ব‌্যবস্থা নেন‌নি। প‌রে চেয়ারম‌্যান‌কে অব‌হিত ক‌রি। পরবর্তী‌তে কা‌জ বন্ধের নি‌র্দেশনা দি‌য়ে উনি (উপসহকা‌রি প্রকৌশলী)চ‌লে যান। ত‌বে ঠিকাদা‌রের লোকজন ব‌্যবহার অ‌যোগ‌্য সেই মিশ্রণ দি‌য়ে কা‌র্পে‌টিংয়ের কাজ ক‌রেন। 

স্থানীয় বাসিন্দা অ্যাড. ইয়া‌সিন বিন সদর ব‌লেন,'আমার বা‌ড়ির পা‌শে রা‌তে কাজ কর‌তে দে‌খে সেখা‌নে যাই। ঠাণ্ডা মিশ্রণ দি‌য়ে কা‌র্পে‌টিং ক‌রা হয়। এছাড়া যথাযথ বিটু‌মিন না দি‌য়ে সড়‌কের ওপ‌রে নামমাত্র বিটু‌মিন ছি‌টি‌য়ে দেয়া হয়। আমরা নি‌ষেধ কর‌লেও কর্ণপাত ক‌রেননি ঠিকাদা‌রের লোকজন।'

স্থানীয় বা‌সিন্দা আফাজ পাড়, তৈ‌য়েবুর রহমান, মোস্তা‌ফিজুর রহমানসহ ক‌য়েকজন জানান,
দীর্ঘ‌দিন সড়কটির বিভিন্ন স্থান খুঁড়ে ফেলে রাখা হ‌য়ে‌ছে। চলাচ‌লে ব‌্যাপক সমস‌্যা হয়। অ‌তি নিম্নমা‌নের খোয়া ব‌্যবহার করা হ‌য়ে‌ছে। সেই খোয়‌া প‌রিবর্তন না ক‌রেই পিচ ঢালাই দেয়া হ‌চ্ছে।  
ফলে জনসাধারণের চলাচলে ভোগান্তি পোহাতে হয়। 

তারা আরও ব‌লেন, রাস্তার দু'পাশে ঠিকমতো মাটি দেয়া হয়নি। রাস্তাটির পাশের হেজিংয়ে নিম্নমানের ইট দেয়া হয়। এছাড়া, ডব্লিউবিএম'র জন‌্য অতি নিম্নমানের ইটের খোয়া ব‌্যবহার করা হয়। একপর্যায়ে স্থানীয়দের বাধার মুখে কয়রা উপজেলা প্রকৌশলীর নির্দেশনায় নিম্নমানের ইট অপসারণ করা হলেও একই ইট পুনরায় ব‌্যবহার করা হয়। নিম্নমানের হওয়ায় সামান‌্য চাপে খোয়া গুঁড়ো হয়ে যায়। এছাড়া,যেভাবে নিম্নমানের ইট ও খোয়া ব‌্যবহার করা হয়ে‌ছে, তাতে টেকসই হবে বলে মনে হয় না। এরপ‌রেও পিচ ঢাল‌াই ঠিকমতো দেয়া হ‌চ্ছে না। কাজ শেষ না হ‌তেই নষ্ট হ‌য়ে যা‌চ্ছে। এভাবে অর্থ অপচয় করার দরকার ছিল না। 

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রওশনারা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, খুলনা জেলা ছাত্র দলের নেতা রুবেল আমার ঠিকাদারি লাইসেন্স ব্যবহার করে ঐ কাজটি করছেন।এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। খুলনা -০৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবুর ঘনিষ্ঠভাজন এই ব্যক্তি আরও বলেন, উপজেলা প্রকৌশলী দারুল হুদার যোগসাজশে সে এই কাজটি করছে।আপনি উপজেলা এলজিইডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারবেন।

খুলনা জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি  ও কাজের তদারককারী  রুবেল বলেন, কিছু সমস্যার কারণে ঐ কাজটি দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ ছিল। দেশের পট-পরিবর্তনের পরে কাজটি দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করতেছি। গতকাল কার্পেটিং এর সময় মেশিনের ত্রুটির কারণে ঠান্ডা পিচ দেওয়া হয়েছিল।তবে এলাকাবাসী ও উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশনা পালন না করে দাম্ভিকতা প্রদর্শনের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে, এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি।তিনি বলেন কাজ ত্রুটিপূর্ণ হলে সমাধান করে দেওয়া হবে।
 
এ বিষয়ে কয়রা উপজেলা প্রকৌশলী মো. দারুল হুদা বলেন, গতকাল কার্পেটিং কাজের সময় উপ-সহকারী প্রকৌশলী আফজাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। ঠান্ডা পিচ দিতে চাইলে তিনি নিষেধ করেন এবং কাজ বন্ধ রাখতে বলে চলে আসেন।পরে ঐ ঠান্ডা পিচ দেওয়ার কথা এলাকাবাসীর জানালে উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তাকে বিষয়টি অবহিত করেছিলাম।আমরা ত্রুটিপূর্ণ কাজ হলে তার বিল আটকিয়ে রাখবো এবং এই কাজে তার সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন।

বিষয়টি জানতে খুলনা জেলা বিএনপি সদস্য সচিব আবু হোসেন বাবুকে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখে উপজেলা প্রশাসনকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন খুলনা জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও কয়রা উপজেলা সভাপতি এ্যাড.মোমরেজুল ইসলাম। 

 উপ‌জেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলী বিশ্বাস ব‌লেন, আমি গতকাল রাতে উপজেলা প্রকৌশলী ও স্থানীয় জনসাধারণের কাছ থেকে বিষয়টি জানতে পেরে কাজ বন্ধের ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। ঐ ওয়ার্ডের মেম্বার ও গ্রাম পুলিশের সহযোগিতায় কাজটি এখন বন্ধ রয়েছে। উপজেলা প্রকৌশলীকে ত্রুটিপূর্ণ কার্পেটিং উঠিয়ে নতুন করে কার্পেটিং করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।